শীতে ঘুরে আসুন খাগড়াছড়ি
ডিসেম্বর মানেই লম্বা ছুটি কাটানর সময়। আর ছুটি মানেই দুরন্তপনায় ছুটে চলা আর বন্ধু-স্বজন নিয়ে ঘোরাফেরা। সময়টাকে পুরোপুরি উপভোগ করতে সবাই যে যার মতো ছুটে চলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
ইট পাথরের শহরের টানা কর্মব্যস্ততাকে পেছনে ফেলে কিছুটা প্রশান্তির জন্য ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়, ঝরনা-ঝিরির খাগড়াছড়ি হতে পারে আপনার ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত জায়গা। লম্বা ছুটি না পেলেও দুই তিনের মধ্যে খাগড়াছড়ির এসব জায়গা দেখে আসতে পারবেন। প্রাণ ভরে প্রাকৃতিক পরিবেশে কয়েক দিন শ্বাস নিয়েও আসতে পারেন।
এখানে ভ্রমণের পাশাপাশি আপনি পাহাড়ের বৈচিত্রময় খাবারের স্বাদও গ্রহণ করতে পারবেন। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাহাড়ের খাবারের মান আর মেন্যুতেও এসেছে নতুনত্বের ছোঁয়া। পাশাপাশি পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষের জীবন, সংগ্রাম, কৃষ্টি- সংস্কৃতির বৈচিত্রময় জীবনাচারের সঙ্গেও পরিচিত হওয়ার বিরল সুযোগ পাবেন।
খাগড়াছড়ি ভ্রমণে আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলি যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি পরিচিত হতে পারবেন নতুন কোনো আবহের সঙ্গে। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই সময় খাগড়াছড়ির কোন কোন জায়গা ঘুরার জন্য উপযুক্ত-
আলুটিলা
খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সড়কের পাশেই খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন আলুটিলা পর্যটন পার্ক। এ পর্যটন কেন্দ্রটির অন্যতম আকর্ষণ রহস্যময় সুরঙ্গ। পাহাড়ের চূঁড়া থেকে ২৬৬টি সিঁড়ি বেঁয়ে নিচে নামলেই সেই স্বপ্নীল সুড়ঙ্গমুখ। প্রায় ২৮২ ফুট দৈর্ঘের আলুটিলা সুড়ঙ্গ যেন বিধাতার অনন্য সৃষ্টি। গা ছমছম করা অনুভূতি নিয়ে পাহাড়ি সুরঙ্গ পথ বেয়ে পাতালে নামা কল্পনার হলেও আলুটিলার সুরঙ্গ কল্পনা নয় বরং বাস্তব। আলুটিলা পর্যটন পাকে প্রবেশ মুখেই আপানাকে স্বাগত জানাবে নান্দনিকতার ছোয়ায় তৈরী বিশাল তোড়ন।
রিছাং ঝরনা
আলুটিলা পর্যটন পার্ক ও রহস্যময় গুহা থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে প্রকৃতির আরেক সৃষ্টি ‘রিছাং ঝর্ণা। শিরশির ছন্দে হিম শীতল ঝরনার বহমান স্বচ্ছ পানি যে কাউকেই কাছে টানবে খুব সহজেই। খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম সড়ক থেকে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে স্বপ্নের রিছাং ঝরনায়। এখানে আগত পর্যটকদের সুবিধার্থে প্রবেশমুখে একটি গেট নির্মাণসহ পর্যটকদের জন্য সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে চেঞ্জিং রুমসহ বেশ ক’টি গোলঘর। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে পুলিশ পাহারাও। একজন ভ্রমণ পিপাসু হিসেবে আপনিও হতে পারেন ‘রিছাং ঝর্ণা’র স্বাক্ষী।
দেবতা পুকুর
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি সড়কের কোলঘেঁষে মাইসছড়ি এলাকার নুনছড়ি মৌজার সমতল ভূমি থেকে প্রায় সাতশ’ ফুট উপরে পাহাড়ের চূড়ায় দেবতা পুকুর রূপকথার দেবতার আশীর্বাদের মতোই সলিল বারির স্রোতহীন সঞ্চার। পাহাড়ের চূড়ায় এ পুকুরটির স্বচ্ছ জলরাশির মনভোলা প্রশান্তি মুহূর্তের মধ্যেই পর্যটকদেরও বিমোহিত করবে। পুকুরের চারদিকে ঘন সবুজ বনরাজি যেন সৌন্দর্যের দেবতা বর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কথিত আছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের জলতৃষ্ণা নিবারণের জন্য স্বয়ং জলদেবতা এ পুকুর খনন করেছেন।
জেলা পরিষদ পার্ক
খাগড়াছড়ি জেলা শহরের খুব কাছাকাছি জিরো মাইল সংলগ্ন ২২ একর ভূমির ওপর গড়ে ওঠা ‘জেলা পরিষদ পার্ক’ হয়ে উঠতে পারে আপনার ভ্রমণের অন্যতম উপভোগ্য। রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত সেতুর আদলে তৈরি ‘ঝুলন্ত সেতু’ আপনাকে নি:সন্দেহে বিমোহিত করবে। এছাড়াও উঁচু-নিচু পাহাড়ের গা ঘেঁষে সারিসারি ফলের বাগান যে কোনো পর্যটকের মন কাড়বেই। প্রিয়জনদের কাছে টানবে লেকের কোল ঘেঁষে যাওয়া টাইলস বসানো আঁকাবাঁকা সড়ক।
মায়াবীনি লেক
পাহাড়ের উঁচু-নিচু ভাঁজে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা ‘মায়াবীনি লেক’। যা খাগড়াছড়ির পর্যটনের আরেক বিস্ময়। খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে ২০ মিনিটের পথ পেরিয়ে দেখা মিলবে বিনোদন কেন্দ্র ‘মায়াবীনি লেক’র। পাহাড়ের উঁচু-নিচু ৪০ একর জমির ওপর ১৫ একর লেকে দ্বীপবেষ্টিত মায়াবীনি লেক যে কাউকে বিমোহিত করবে।
জলপাহাড়
মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরের একমাত্র বিনোদন পার্ক জলপাহাড় হতে পারে আপনার বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন জলপাহাড়ে। নাগরদোলা আর ময়ূরপঙ্খী নৌকা হয়ে উঠবে আপনার বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। জলপাহাড়ের সুবিশাল লেক আপনাকে বাড়তি আনন্দ দেবে নিঃসন্দেহে।
হেরিটেজ পার্ক
পাহাড়ের কোলঘেঁষে সর্পিল প্রবাহ নিয়ে বয়ে যাওয়া চেঙ্গী নদীর কোলে জেলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত ‘হেরিটেজ পার্ক’ পর্যটনপিপাসুদের নতুন ঠিকানা। পর্যটন মোটেলের বিপরীতে সৌন্দর্যমন্ডিত ও নান্দনিক হেরিটেজ পার্কটির অবস্থান। পাহাড়ের প্রকৃতি অক্ষত রেখে গড়ে তোলা এ পার্কে বসলে চেঙ্গী নদীর ঝিরিঝিরি মৃদু ঠান্ডা বাতাস আপনি পাবেন হিমেল ঠান্ডা পরশের ছোঁয়া।
ভগবান টিলা
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলা থেকে সোজা উত্তরে ভারতের সীমান্তবর্তী ভগবান টিলা। জেলা সদর থেকে উত্তর-পশ্চিমে এর কৌণিক দূরত্ব আনুমানিক ৮৫ কিলোমিটার। সবুজের বুক চিরে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এগোলে পাহাড়ের অপরূপ নিঃসর্গের অপলক নেত্র ততই বিস্ময় বিহ্বল হবেই। এ টিলা যেন বিধাতার নিজ হাতে গড়া পর্বত রূপসী। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় এক হাজার ছয়শ’ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এ টিলা সম্পর্কে স্থানীয়দের ধারণা, এ টিলার উপরে দাঁড়িয়ে ডাক দিলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও ওই ডাক শুনতে পান।
রামগড় চা বাগান
জেলার রামগড়ে সীমান্ত ঘেঁষে খাগড়াছড়ি জেলায় প্রবেশের সম্মুখভাগে খাগড়াছড়ি-ফেনী আঞ্চলিক মহাসড়কের দু’পাশে গড়ে উঠেছে বিশাল চা বাগান। যা খাগড়াছড়ির পর্যটন শিল্পকে করেছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশাল এলাকাজুড়ে এই চা বাগানে আসলে পর্যটকরা বুঝতেই পারবে না, তারা চা বাগানের ভূমি খ্যাত সিলেট আছেন না পর্যটনের তীর্থভূমি খাগড়াছড়িতে।
রামগড় লেক
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে খাগড়াছড়ির প্রবেশদ্বার রামগড় উপজেলা। উপজেলা পরিষদের সম্মুখভাগে ইংরেজি ডব্লিউয়ের অনুরূপ প্রায় ২৫০ মিটার লম্বা একটি হ্রদ। চারপাশ বাঁধানো লেকটি রেলিং ঘেরা এবং বাহারি সাজে সজ্জিত রামগড় পর্যটন লেকটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন।
লেকের উভয় পাশে যোগাযোগের জন্য মাঝখানে রয়েছে জিরাফ আকৃতির সুদৃশ্য ঝুলন্ত সেতু। লেকের দুই তীরে রয়েছে মনোমুগ্ধকর উদ্যান। এ উদ্যানে আগত দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য রয়েছে ১২টি শেড। এ লেকটি হতে পারে আপনার ভ্রমণের জন্য এক অনন্য স্থান।
বিডিআরের জন্মভূমি
খাগড়াছড়ির সাবেক মহকুমা শহর রামগড়। তৎকালীন বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) জন্মস্থান এ রামগড়। বিজিবির শেকড়ের ইতিহাস জানা যাবে রামগড়ে। এখানে ফেনী নদীর কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বিজিবি স্তম্ভ। যেখানে খোদাই করে লেখা আছে, ১৭৯৫ সালের ২৯ জুন ‘রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন’র জন্ম ইতিহাস। এখানে রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অনেক স্থান, স্থাপনা। রয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিভাজনকারী ফেনী নদী।
মানিকছড়ি রাজবাড়ী
খাগড়াছড়ি-চট্ট্রগাম সড়কের খাগড়াছড়ি জেলার প্রবেশমুখ মানিকছড়ি উপজেলা সদরে রয়েছে খাগড়াছড়ির অন্যতম দশর্নীয় স্থান মানিকছড়ি রাজবাড়ী। রাজবাড়ীতে রয়েছে মং সার্কেল চিফের (মংরাজা) রাজত্বকালীন স্থাপত্য। রাজার সিংহাসন, মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রত্নতাত্ত্বিক অনেক স্মৃতি বিজড়িত এই রাজবাড়ী। আপনার ভ্রমণে মানিকছড়ি রাজবাড়ী হতে পারে অন্যতম আকর্ষণ।
শতবর্ষী বটগাছ
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরের খুব কাছাকাছি আলুটিলা-বটতলী এলাকায় এ প্রাচীন শতবর্ষী বটবৃক্ষটি শুধু ইতিহাসের সাক্ষী নয়, এ যেন দর্শনীয় আশ্চর্যের কোনো উপাদান। দুই একরের অধিক ভূমির উপরে এ গাছটি হাজারো পর্যটকের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়।
কান্তিপুর অরণ্য কুটির
১৯৯৯ সালে বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু শাসনারক্ষী স্থবির খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা পানছড়ির উল্টাছড়ি ইউনিয়নে গড়ে তোলেন শান্তিপুর অরণ্য কুটির। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি তীর্থস্থানের মতো। এ কুটিরের প্রধান আকর্ষণ বিশালকায় বৌদ্ধমূর্তি। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় গৌতম বুদ্ধের মূর্তির দেখা মিলবে সবুজে ঘেরা শান্তিপুর অরণ্য কুটিরে।
তৈদুছড়া ঝরনা
খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় সবুজ পাহাড় আর বুনো জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত নয়নাভিরাম ঝরনা দুটির নাম তৈদুছড়া ঝরনা। ত্রিপুরা ভাষায় ‘তৈদু’ হলো ‘পানির দরজা’ আর ‘ছড়া’ মানে ‘ঝরনা’। এ দু’য়ে মিলে দীঘিনালার ‘তৈদুছড়া ঝরনা’। অসাধারণ সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক বৈচিত্র তৈদুছড়াকে এনে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। যা একবার দেখলে বার বার ছুটে আসতে চাইবেন। দীঘিনালার দুর্গম পাহাড়ের ‘তৈদুছড়া ঝরনা’ হতে পারে আপনার বিনোদনের বড় ক্ষেত্র।
কিভাবে আসবেন
ঢাকার কমলাপুর, সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, কলাবাগান থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে খাগড়াছড়িতে। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির দূরত্ব ৩১৬ কিলোমিটার । আর চট্টগ্রামের অক্সিজেন বা বায়েজীদ থেকে খাগড়াছড়ি অভিমুখী গাড়িতে উঠতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ির দুরত্ব ১০৯ কিলোমিটার।
ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন হুন্দাই (এসি-নন এসি), গ্রীণ লাইন (এসি), শ্যামলী, লনডন এক্সপ্রেস (এসি), হানিফ (এসি-নন এসি), শান্তি পরিবহন, এস আলম, সৌদিয়া, রিল্যাক্স (এসি-নন এসি), ও ঈগল প্রায় সবধরনের বাস পাবেন। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়াও আপনার শহর থেকে আসা গাড়িতে করে খাগড়াছড়ির প্রাণকেন্দ্র শাপলা চত্বর গাড়ি থেকে নামতে হবে। শাপলা চত্বর থেকেই আপনি পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সবধরনের গাড়ি পাবেন।
কোথায় থাকবেন ও কি খাবেন
খাগড়াছড়ি শহরের প্রবেশ মুখে চেঙ্গী নদীর তীর ঘেঁষে রয়েছে পর্যটন মোটেল। এছাড়াও জেলা সদরে আপনার জন্য রয়েছে মানসম্মত সব হোটেল-রিসোর্ট। সেখানেও থাকা-খাওয়ার সুযোগ-সুবিধা রয়েছে হাতের নাগালেই। খাগড়াছড়ির পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসবেন আর পাহাড়ের বৈচিত্রময় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করবেন না, তা কি হয়? ভিন্ন ধরনের আতিথেয়তায় খাগড়াছড়ির খাবারেও রয়েছে পর্যটনের স্বাদ। খাগড়াছড়ির খাবারের মান ও মেন্যু মিলে আপনার ভ্রমণে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে।
s J