রেলের বাংলো দুর্নীতি: দোষীকে শাস্তির বদলে ‘পুরস্কার’!
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে রেলের বাংলো ব্যবহারের সুবিধা দেওয়ায় রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) পরিদর্শক ও চট্টগ্রামের সিজিপিওয়াই চৌকির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমান উল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় সুপারিশ করা হয়েছিল ১ বছর আগে। কিন্তু এতদিনেও সেই সুপারিশের বাস্তবায়ন হয়নি। বরং, তাকে আরও 'গুরুত্বপূর্ণ' পদে বদলি করা হয়েছে।
আমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেনিং অ্যাকাডেমির ৯ নম্বর বাংলো এবং আশেপাশের ভূমি একটি প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছেন।
পরে, তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং ব্যবস্থা নেওয়ায় সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে মেসার্স সিলভার জুবিলি লিমিটেডকে ওই বাংলোসহ রেলওয়ের ২৫ দশমিক ৯০ একর জায়গা লিজ দেওয়া হয়। কিন্তু শর্ত ভেঙে ২০১৮ সালে সিলভার জুবিলি লিমিটেডের লিজ বাতিল করে রেল কর্তৃপক্ষ। এরপর ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট ২৫ দশমিক ৯০ একর জায়গায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে রেলওয়ে।
২০২১ সালের নভেম্বরে আরএনবি চিফ কমান্ড্যান্টের (পূর্ব) কাছে আমান উল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ হওয়া রেলের সম্পদ অবৈধভাবে ভোগ-দখলের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ তোলেন রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমির তৎকালীন রেক্টর মনির হোসেন।
অভিযোগে বলা হয়, ২০২১ সালের মার্চে করোনাকালীন লকডাউনে আমান উল্লাহ আমান অবৈধ দখল থেকে উচ্ছেদ করা বাংলো ও জায়গা পুনরায় অবৈধ দখলদারদের কাছে হস্তান্তর করেছেন।
অভিযোগ তদন্তে ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করে রেলওয়ে। তদন্ত শেষে আরএনবি চিফ কমান্ড্যান্টের (পূর্ব) কাছে আমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশসহ ৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ৫ জুন আমান উল্লাহ আমান সিজিপিওয়াই চৌকির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগ দেন। দায়িত্বে থাকাকালীন উচ্ছেদ করা প্রতিষ্ঠান পুনরায় রেলের সম্পত্তি দখল করলেও তিনি সেটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাননি। তিনি দখলদারদের বাধা দিয়েছেন এমন কোনো প্রতিবেদন দেখাতে পারেননি। পাশাপাশি এ বিষয়ে কোনো জিডি কিংবা প্রশাসনিক ব্যবস্থার চিঠি দেখাতে পারেননি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুযায়ী আরএনবির ওপর রেলের সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু, আরএনবি সেই দায়িত্ব পালন করেনি। সুতরাং, সিজিপিওয়াই চৌকির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমান উল্লাহ আমান তার দায় এড়াতে পারেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটির একজন সদস্য বলেন, 'তদন্ত করার সময় আমরা ১৪ জনের জবানবন্দি নিয়েছি। রেলের সম্পদ অবৈধভাবে ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগও পেয়েছিলাম। তবে সে অভিযোগ আমরা প্রমাণ করতে পারিনি। কিন্তু, দায়িত্বে অবহেলা ছিল আমানের। মূলত তার নীরবতা এবং সহযোগিতার কারণে প্রকাশ্যে এভাবে রেলের সম্পদ ভোগ করেছিল অবৈধ দখলদার। তাই যৌথ প্রতিবেদনে আমান উল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা ছিল। আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলাম।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আমান উল্লাহ আমান প্রথমে দায় এড়িয়ে বলেন, 'আমি জয়েন করার আগে রেলের বাংলো দখল হয়ে গিয়েছিল।'
পরে তদন্ত প্রতিবেদনে তার যোগদানের তারিখ উল্লেখ থাকার কথা জানালে তিনি চুপ হয়ে যান।
এরপর তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, 'রেলের সম্পদ দেখার দায়িত্ব ভূ-সম্পত্তি বিভাগের। আমাকে কেন প্রশ্ন করছেন? কোনো কিছু জানার থাকলে ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
তদন্তে প্রতিবেদনে তাকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি নিরপরাধ। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।'
পরে তিনি এই প্রতিবেদকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। পাশাপাশি এ বিষয়ে সংবাদ না করার অনুরোধ করেন।
তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার এক বছর পার হলেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না- জানতে চাইলে আরএনবি চিফ কমানড্যান্ট (পূর্ব) জহিরুল ইসলাম বলেন, 'প্রাথমিক শাস্তি হিসেবে তাকে আমরা চট্টগ্রাম থেকে অন্যত্র বদলি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কারণে আমরা তাকে বদলি করতে পারিনি। প্রশাসনিক জটিলতার কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সময় লাগছে। তবে যেকোনো সময় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
রেল স্টেশনের আরএনবির সিআই পদটি নিরাপত্তা ও কর্মক্ষেত্রের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই পদের জন্য অনেকে মন্ত্রণালয় এমনকি মন্ত্রীর সুপারিশও নিয়ে আসেন।
অভিযুক্ত আমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে তাকে চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সিজিপিওয়াই থেকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে বদলি করায় এই বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বিভাগে কর্মরত আরএনবির একজন সহকারী কমানড্যান্ট ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শাস্তির বদলে আমান উল্লাহকে পুরস্কৃত করা হয়েছে, যা অনেকের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করবে।'
এ বিষয়ে চিফ কমানড্যান্ট (পূর্ব) জহিরুল ইসলাম বলেন, 'মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) মহোদয়ের নির্দেশনা ছাড়া আমি বদলি করতে পারি না। এখানে আমার হাত নেই।'
জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন ২৫ ডিসেম্বর ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনেক আগে তার বসকে (চিফ কমানড্যান্ট (পূর্ব) নির্দেশ দিয়েছি। কেন এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তার খোঁজ নেব।'
সুত্র: দ্যা ডেইলি স্টার